ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি ‘মজাদার’ সেমাই

তারপরও যেন পরিতৃপ্তি ঈদের দিনে
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি ‘মজাদার’ সেমাই

ঈদের দিনে সেমাই খাবার দাওয়াত দেয়া এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ফোনালাপের শেষে বিনয়ের সঙ্গে ঈদের দিনের সেমাই খাওয়ার দাওয়াত দেয়ার রীতি দীর্ঘদিনের। মানুষ সেমাই খাওয়ার দাওয়াত কবুলও করছেন। অন্যকেও অনুরূপভাবে দাওয়াত দিচ্ছেন। বিত্তবানদের ঘরে নানা রকমের নানা স্বাদের সেমাই রান্না হয়। সেমাই সুস্বাদু করতে ব্যবহার করা হয় নানা রকমের উপকরণ। দুধ চিনি, কিশমিশ, বাদাম, নারকেল, গরম মশলা ও জর্দার রং ব্যবহার করে সেমাইয়ে নিয়ে আসা হয় ভিন্ন স্বাদ। স্বাদের সঙ্গে পরিবেশনেও আনা হয় নানা বৈচিত্র্য। ঈদের দিনে এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে সেমাই রান্না হয় না। সবচেয়ে অধিক এবং জনপ্রিয় এই আপ্যায়ন সামগ্রীর উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তা কম নয়। খুব বেশি দিন আগে নয় যখন মানুষ ঘরে তৈরি সেমাই ঈদের দিনে রান্না করত। রমজানের শুরুতেই সেমাই তৈরির কাজে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা নিয়োজিত থাকতেন। হালকা পরিশ্রমের এই কাজটি করতে তারা অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কেননা ঈদের খুশির দিনে প্রিয়জনরাই খাবে তার হাতের তৈরি সেমাই। আঙুল গড়িয়ে সেমাই পড়ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়ে। সেই সেমাই রোদে শুকিয়ে রাখা হতো বিশেষভাবে প্রক্রিয়াকরণকৃত পাত্রে। হাতে তৈরি সেমাই আপনজনদের পরিবেশন করতে ভিন্ন একটা সুখ অনুভব হতো। যারা খেতেন তারাও মান ও পুষ্টিমানের কথা বিবেচনায় নিয়ে পছন্দ করে কিচুটা বেশিই খেতেন। ঘরের তৈরি সেমাই খাওয়ার দাওয়াত দেয়ার মধ্যে এক প্রকার অভিজাত্য ফুটে ওঠে। তবে আমরা কি কখনো চিন্তা করি বাইরের কারখানার কি সেমাই খাচ্ছি আমরা। কোন পরিবেশে কোন ধরনের শ্রমিক কীভাবে সেমাই কারখানায় কাজ করে সেই চিন্তা আমাদের মাথায় সাধারণত না আসারই কথা। কেননা কারখানার পরিবেশ আমরা কখনো দেখি না। দেখার চেষ্টাও করি না। যাদের দেখার কথা তারাও দেখেন না। ফলে প্রতিনিয়ত মানুষ ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর ‘মজাদার’ সেমাই খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। সেমাই তৈরির কারখানার শ্রমিকদের অপরিচ্ছন্ন হাত-পা ছাড়াও ঘামের প্রবাহ সেমাইয়ে খামির ওপর পড়ে। সেই সঙ্গে পোড়া তেলে সেমাই ভেজে প্যাকেটজাত করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা হয়ে থাকে। সেমাই খেতে মজাদার তবে এর তৈরির পেছনের কাহিনী আতঙ্কজনক ও বিপজ্জনক। যেহেতু সেমাই তৈরির প্রক্রিয়া দেখে শুনে কেনার সুযোগ কারো না হওয়ারই কথা। তারপরও আমরা ঈদে সেমাই কিনি নামি-দামি ব্র্যান্ডের। কিন্তু সেগুলোও কি মানসম্মত, পরিচ্ছন্ন বা উপাদেয়! সেই প্রশ্ন এড়িয়ে আমরা ঈদ বাজার তালিকায় প্রথমে রাখি সেমাই। উৎপাদন পক্রিয়ায় মান বজায় রাখার দায়িত্ব যারা পালন করেন তারা সেই কাজটি যথাযথভাবে করলে মানুষ নিশ্চিন্ত মনে সেমাই খাবার লোভটা লালন করতে পারে।

ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কারখানায় তৈরি হচ্ছে বাহারি নামে সেমাই। এসব সেমাই চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন হাট বাজার কিংবা বিতনি বিতান ও শপিং মলে। সেমাই কারখানা গুলোতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে শ্রমিকরা। রমজানের শুরু থেকে প্রতিদিন এ ব্যস্ততা বেড়েই চলছে। তবে এসব কারখানার নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে তৈরি সেমাই কতটা স্বাস্থ্য সম্মত সেটা নিয়ে মানুষের কোন ভাবাবেগ নেই। নিম্নমানের ঢালডা আর পোড়া তেল দিয়ে ভাজা এই সেমাইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআইয়ের কোন নজরদারি বা স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের তেমন কোন নজরদারিও নেই। শ্রমিকদের হাত থেকে শরীরের ঘাম পড়ে সেমাইতে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব লাচ্ছা সেমাই তৈরির সময় হাতের গ্লাবস ব্যবহার করছে না তারা। তাই শরীরের ঘাম এ সেমাইয়ের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আনায়াসেই।

কারখানায় হাতে গ্লাবস এবং মাস্ক ব্যবহার না করায় শ্রমিকদের হাতে থাকা বড় বড় নখ ও হাঁচি-কাশির ময়লা পড়ছে তৈরি সেমাইয়ে। এরসঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নিম্ন মানের ঢালডা ও পোড়া তেল। এভাবেই প্রতিদিন তৈরি করা হচ্ছে শত শত মণ সেমাই। ময়লা, গাদ ও দুর্গন্ধযুক্ত ট্রে এবং কাদাযুক্ত মেঝে পরিষ্কার করার কোনো উদ্যোগ নেই মালিক পক্ষের।

বিএসটিআই ও স্যানিটারি পরিদর্শক কারখানায় যাওয়ার আগে নাকি মালিক পক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তাদের জানিয়ে পরিদর্শনে যান। এ কারণে নাকি জরিমানা করার মতো কোনো সুযোগ থাকে না। বছরের অন্য সময় সোমাই কারখানার পরিবেশ নিয়ে মালিক পক্ষে কোনো রকম মাথা ঘামান না। অথচ সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের লোকজন কারখানায় আসার খবর পেয়ে মালিকপক্ষ অন্তত একটি দিনের জন্য কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুস্মরণ করেন। ফলে জেল জরিমানা করার কোনো সুযোগ পান না বিএসটিআিই কিংবা স্যানিটারি পরিদশকরা।

সেমাই তৈরির জন্য খামি (ময়দা দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করণ) রাখার ট্রের উপরে বসে আবার কখনো বা হাঁটাহাঁটি করে কাজ করছে শ্রমিকরা। সেমাইয়ের মন্ড (খামি) তৈরি করতে একাধিকবার ব্যবহৃত তেল কাজে লাগানো হয়। এছাড়া যেন উপায় থাকে না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সেমাই কারখানার পরিবেশ এবং উৎপাদিত সেমাই ভোক্তাদের স্বাস্থ্যসম্মত কি না তা দেখতে অভিযান পরিচালনা করা হলেও কারখানায় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বছরের সব সময় নিশ্চিত করা কঠিন।

পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারির কথা জানানো হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। প্রশ্ন করলে সাফ জবাব, লোকবলের অভাব। এসব প্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত লোকবল থাকে না। তবে যারা থাকেন তারাও যদি তাদের সাধ্যমতো দায়িত্ব পালন করেন তা হলে সুষম পুষ্টি নিয়ে গড়ে উঠবে আমাদের আগামী প্রজন্ম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত